সম্পদ কেন্দ্রীকরণ কি বন্ধ করা সম্ভব? -- মুহাম্মদ ইউনূস
22 Mar, 2017
জনগণের বিজয়
প্যারিস জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন ২০১৫-এর ফলাফল আমাকে রোমাঞ্চিত ও আশান্বিত করেছে। চল্লিশ বছর ধরে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে চলা যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসীদেরই জয় হয়েছে। তারা সকলকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, পৃথিবী একটি সত্যিকারের বিপদের মধ্যে রয়েছে এবং আমাদের সকলকেই একযোগে কাজ করতে হবে। পৃথিবীকে আসন্ন পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে প্যারিস সম্মেলন ছোট-বড় সকল জাতিকে একটি আইনগভাবে বাধ্যবাধকতাপূর্ণ দলিলে স্বাক্ষর করাতে পেরেছে। রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ সকলকে বহু বছরে সঞ্চিত দেয়াল-লিখনগুলো বোঝানোর পর্বতসম কাজটি করার জন্য আমি প্রতিনিয়তঃ এই সক্রিয় কর্মীদের ধন্যবাদ জানাই। রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বোধোদয় সৃষ্টির কাজটিকে তাঁদের অনেকেই আজীবন-সংকল্প হিসেবে নিয়েছিলেন। জনগণের মধ্যে যাঁরা নিশ্চুপ ছিলেন, তাঁরাও ক্রমান্বয়ে সক্রিয় কর্মীতে পরিণত হলেন। তাঁরা পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় এমন রাজনৈতিক নেতাদের ভোট দিলেন। পরিবেশ সচেতন রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে জয়ী হতে শুরু করলো।
প্যারিস সম্মেলনকে আমি অঙ্গীকারবদ্ধ সক্রিয় কর্মীদের নেতৃত্বে জনগণের বিজয় হিসেবে দেখছি। এই কর্র্মীরা কখনোই তাঁদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। এমনকি প্যারিস সম্মেলন চলাকালে পৃথিবীর ১৭৫টি দেশে ২,৩০০টি স্থানে ৭,৮৫,০০০ মানুষ একত্রিত হয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে তাদের ভালবাসার পৃথিবীকে রক্ষা করে একটি শতভাগ নিরাপদ ভবিষ্যতের দাবী তুলেছে। সাধারনতঃ আমরা সরকারগুলোকেই তাদের সাহসী পরিকল্পনার পক্ষে জনগণকে সংঘবদ্ধ করতে দেখি। তবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে আমরা এর বিপরীতটাই দেখতে পেলাম। এখানে পৃথিবীজুড়ে নাগরিকরাই তাদের সরকারগুলোকে চালিত করেছে।
প্যারিস সম্মেলন আমাকে এই বিশ্বাসে অনুপ্রাণিত করেছে যে, এ ধরণের গণ-আন্দোলন দিগন্তে জমতে থাকা আরেকটি আসন্ন দুর্যোগ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারবে। রাজনীতিতে যুগ যুগ ধরে এটি একটি উত্তপ্ত বিষয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই সমস্যাটি মোকাবেলা করতে অনেক শক্তিশালী আন্দোলন, অনেক উচ্চকাংখী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অনেক রক্তও এজন্য ঝরেছে। কিন্তু এর সুরাহাতো হয়ইনি, বরং সমস্যাটি প্রতিনিয়তঃ আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। সমস্যাটি হচ্ছে মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পদ বৈষম্যের ক্রমাগত বিষ্ফোরণ। এই বৈষম্য স্থানীয়, জাতীয় ও বৈশ্বিকভাবে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার যত বাড়ছে, সম্পদের বৈষম্যও ততই বেড়ে চলেছে। এই দুর্যোগটি ভয়ংকর, কেননা এটি মানুষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে। এটি পৃথিবীকে একের পর এক সামাজিক সংঘর্ষের দিকে ধাবিত করে। এটি জাতিসমূহের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ সৃষ্টি করে।
সম্পদ কেন্দ্রীকরণ সংক্রান্ত অক্সফামের তথ্য
অক্সফাম সম্পদ কেন্দ্রীকরণের উপর প্রতি বছর আমাদের ভীতিকর আপডেট দিয়ে আসছে। এ বছর তারা বলছে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৬২ জন ব্যক্তির সম্পদ পৃথিবীর নীচের অর্ধেক মানুষের মোট সম্পদের চাইতেও বেশী। ২০১৫ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৮০ জন এবং ২০১৪ সালে সবচেয়ে ধনী ৮৫ জন ব্যক্তির সম্পদ তখনকার পৃথিবীর অর্ধেকাংশ মানুষের মোট সম্পদের চেয়ে বেশী ছিল বলে অক্সফাম আমাদের জানিয়েছিল। ছয় বছর আগে, ২০১০ সালে, পৃথিবীতে একই ধরনের ভাগ্যবানের সংখ্যা ছিল ৩৮৮ জন। অক্সফাম আরো জানিয়েছিল যে, ২০০৯ ও ২০১৪ সালের মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ৮০ জন ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
২০১৬ সালের জন্য অক্সফামের কিছু ভীতিকর তথ্য রয়েছে। তাদের হিসাব মতে, এ বছর পৃথিবীর ৯৯% সম্পদ সবচেয়ে ধনী ১% মানুষের দখলে থাকবে। অর্থাৎ পৃথিবীর ৯৯% মানুষের কাছে থাকবে পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র ১%।
অক্সফামের এসব তথ্য এতই চমকে ওঠার মত যে প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এসব তথ্য আমাদের মনে আরো অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে। পৃথিবীর ক’জন শীর্ষ ধনীর কাছে, ধরুন ২০২৫ সালে, এই গ্রহের অর্ধেক মানুষের মোট সম্পদের চাইতে বেশী সম্পদ থাকবে? কখন পৃথিবীর একজন মানুষের কাছে নীচের অর্ধেকাংশ মানুষের মোট সম্পদের চাইতেও বেশী সম্পদ থাকবে। আমাদের হয়তো বেশীদিন অপেক্ষা করতে হবেনা। মাত্র ছয় বছরে এই সংখ্যাটি যদি ৩৮৮ থেকে ৬২ জনে নেমে আসতে পারে, মাত্র একজন ভাগ্যবান ব্যক্তির কাছে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের সম্পদের চাইতেও বেশী সম্পদের মালিকানা চলে আসতে খুব একটা দেরী হবে বলে মনে হয় না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স তাঁর নির্বাচনী বক্তব্যে বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট জাতীয় সম্পদের ৯০% সে দেশের সবচেয়ে ধনী ০.১% লোকের দখলে রয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থা কী রকম? এদেশের ৬২ জনের হাতে, নাকি তার বেশী বা কম সংখ্যক মানুষের হাতে নীচের অর্ধেকাংশ মানুষের মোট সম্পদের চাইতেও বেশী সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। এটা নিয়ে কি কারো কোন দুর্ভাবনা আছে। কোন দেশের নীচের অর্ধেকাংশ মানুষের সম্পদের চাইতে বেশী সম্পদ যদি ১ জন লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন কী হবে? নিঃসন্দেহে তিনি হয়ে যাবেন ‘রাজা’। তাঁর ইচ্ছাই হবে দেশের আইন। এমনটা ভাবাটি কি খুব বেশী হয়ে যাবে?
সম্পদের কেন্দ্রীকরণ একই সাথে ক্ষমতারও কেন্দ্রীকরণ - রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা, সুবিধা ও সুযোগের কেন্দ্রীকরণ। এর বিপরীতটাও সত্য। আপনার যদি সম্পদ না থাকে তাহলে আপনার ক্ষমতা, সুযোগ, সুবিধা কিছুই নেই। পৃথিবীর নিচের দিকের অর্ধেক মানুষ যারা পৃথিবীর মোট সম্পদের ১ শতাংশেরও ক্ষুদ্রাংশের মালিক তারা এই শ্রেণীভূক্ত। আগামীকাল পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।
আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদের কেন্দ্রীকরণ একটি বিরামহীনভাবে চলতে থাকা প্রক্রিয়া। আমি এই বিষয়টির প্রতিই আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ধনী মানুষ মানেই কিন্তু অবশ্যম্ভাবীভাবে খারাপ মানুষ যাঁরা অসৎ উদ্দেশ্যে সম্পদকে ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত করে যাচ্ছেন এবং মানুষে-মানুষে বৈষম্য বৃদ্ধি করছেন - এটা ধরে নেয়া ঠিক হবে না । তাঁরা ভাল হোন মন্দ হোন আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই তাঁদের পক্ষে কেন্দ্রীকরণের কাজটি করে যাচ্ছে। সম্পদ হচ্ছে চুম্বকের মত। চুম্বক যত বড় তার আকর্ষণী ক্ষমতা তত বেশী। সে ছোট চুম্বকগুলোকে তার নিজের দিকে টেনে আনে। আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিও এভাবেই গড়ে উঠেছে। যাঁদের হাতে চুম্বক নেই তাঁদের পক্ষে কোন কিছু নিজের দিকে টেনে আনা খুব কঠিন। তাঁরা কোনভাবে ছোট একটি চুম্বকের মালিক হয়ে গেলে তা ধরে রাখাও তাঁদের জন্য শক্ত; বড় চুম্বকগুলো সেগুলো তাঁদের হাত থেকে কেড়ে নেয়। একমুখী সম্পদ কেন্দ্রীকরণের শক্তিগুলো সম্পদ-পিরামিডের আকৃতি প্রতিনিয়তঃ পরিবর্তন করে দিচ্ছে: এর ভিত্তিটা ক্রমাগত সরু হয়ে আসছে, আর এর চূড়াটা হচ্ছে আরো সরু, আরো উঁচু - যা শেষ পর্যন্ত একটি সরু কিন্তু বড় ভিত থেকে গজিয়ে ওঠা একটি শীর্ণ হয়ে আসা স্তম্ভের মতো দেখায়।
এই ভয়াবহ বাস্তবতাগুলো আমাদের প্রতিদিনকার ব্যস্ত জীবন-যাপনের মধ্যেই প্রতি মূহুর্তেই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, এই গ্রহের তাপমাত্রা নিরবে, অনেকটা আমাদের অজান্তেই কয়েক মাস আগে শিল্প বিপ্লবের সময়কালের চেয়ে ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এই বড় পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য না করলে আমাদের এই গ্রহটি ক্রমাগত উত্তপ্ত হতে থাকবে এবং এক সময়ে আমরা এমন এক যায়গায় পৌঁছে যাবো যেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব হবেনা। আমাদের নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী ও সক্রিয় কর্মীদের বহু বছরের রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রমই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সরকারগুলোকে চালিত করার মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক সমঝোতা সম্ভব করে তুলেছে।
সম্পদের কেন্দ্রীকরণ পরিবেশ বিপর্যয়ের মতোই ভয়ংকর। এই ভীতির একটি হচ্ছে, পৃথিবী ভৌতিকভাবে টিকে থাকবে কি-না। অপরটি ভীতিটি মানবতার বিরুদ্ধে, অর্থাৎ আত্মমর্যাদা ও প্রশান্তির সাথে এবং উচ্চতর আদর্শের অনুসন্ধানে বেঁচে থাকার অধিকার মানুষের থাকবে কি-না।
যদি সমাজের সকল অংশের নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী ও পরিবেশ কর্মীদের নেতৃত্বে নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন করতে পারে, তাহলে একই রোড ম্যাপ অনুসরণ করে আমরা ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলা সম্পদ-কেন্দ্রীকরণের আসন্ন ঝুঁকি থেকে পৃথিবীকে রক্ষার উদ্দেশ্যে মানুষকে সমবেত ও উজ্জীবিত করতে পারবো বলে আমি বিশ্বাস করি। নাগরিকদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় সম্পদ-সামঞ্জস্যের ছোট ছোট দ্বীপ গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে, উৎসাহিত করতে হবে যে এটা করা সম্ভব এবং এটা করতেই হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমরা এমন এক যুগে বাস করছি যেখানে আমরা অসম্ভবকে দ্রুত এবং আরো দ্রুত সম্ভব করতে পারি। এটিও এমনই একটি অসম্ভব, হাজারো বাধা সত্ত্বেও যাকে আমাদের খুব দ্রুত সম্ভব করে তুলতে হবে।
এটা কিভাবে সম্ভব আমি এখন সে বিষয়ে বলতে চাই।
মানুষই সব কিছুর কেন্দ্রে
সম্পদ বিষ্ফোরণ কি বন্ধ করা সম্ভব?
আমার দৃঢ় উত্তর হচ্ছে: হ্যাঁ, সম্ভব। মানুষ চাইলে যে-কোন কিছু করতে পারে, তবে এর পেছনে দৃঢ় ইচ্ছা থাকতে হবে। সরকার ও চ্যারিটিগুলো সনাতন উপায়ে যা করে আসছে তার দ্বারা এটা সম্ভব না। প্রত্যেককে এটা তার ব্যক্তিগত অগ্রাধিকার হিসেবে নিতে হবে। মানুষকে নিজেদেরই এজন্য নেতৃত্বের ভূমিকায় এগিয়ে আসতে হবে এবং এটা সম্ভব করার জন্য উপযুক্ত নীতি-কাঠামো তৈরীতে এগিয়ে আসতে সরকারের উপর শক্তিশালী চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
প্রায় ২৫০ বছর আগে আধুনিক পুঁজিবাদের উদ্ভবের পর মুক্ত বাজারের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বাস করা হয়েছে যে, বাজারের “অদৃশ্য হাত” অর্থনীতিতে প্রাতিযোগিতা নিশ্চিত করে এবং বাজারে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করে। আরো বিশ্বাস করা হয়েছে যে, ব্যক্তিরা যার-যার নিজের স্বার্থ অনুসন্ধান করলেই - সমাজের মঙ্গলের চিন্তা না করে - তা নিজে থেকেই সমাজের মঙ্গল সাধন করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: এই অদৃশ্য হাত কি সমাজের সকলের জন্য সমান মঙ্গল নিশ্চিত করে?
এতে কোন সন্দেহ নেই, এই অদৃশ্য হাত একান্তভাবে অতি ধনীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। আর এর ফলেই সম্পদের এই প্রবল কেন্দ্রীকরণ কখনোই থামছেনা।
কিভাবে সম্পদ কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেয়া যায়
সম্পদ-পিরামিডকে রুহিতন-আকৃতির (Diamond-Shaped) সম্পদ বন্টনে রূপান্তরের সম্ভাবনায় আমার বিশ্বাস আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে প্যারিসে জনগণের বিজয় দেখে। আমি এখন নিশ্চিত যে আমরা চাইলেই সম্পদের বিষ্ফোরণকে রুদ্ধ করতে পারি। প্রথমতঃ এটা কোনো অপরিবর্তনীয় নিয়তি নয় যা নিয়ে মানুষ জন্ম গ্রহণ করেছে। যেহেতু এটা আমাদেরই সৃষ্টি, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো এ সমস্যার সমাধানও আমরাই করতে পারবো। আমাদের মনের রুদ্ধতাই আমাদেরকে সমস্যাটি দেখতে দিচ্ছে না এবং আমাদেরকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে আমাদের অবরুদ্ধ মনকে মুক্ত করতে। প্রচলিত চিন্তাধারা, যেগুলো আমাদের এই সমস্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে সেগুলোকে আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে।
এ সমস্যা মোকাবেলায় রাজনৈতিক প্রচারণায় সচরাচর যা গুরুত্ব পায় তা হলো আয়-বৈষম্য, সম্পদ-বৈষম্য নয়। আয়-বৈষম্যকে যে কর্মসূচির দ্বারা মোকাবেলা করা হয় তা হলো আয় পুনর্বন্টন। ধনীদের নিকট থেকে নাও (প্রগতিশীল করের মাধ্যমে) আর গরীবদের দাও (বিভিন্ন ট্রান্সফার পেমেন্টের মাধ্যমে) ।
নিঃসন্দেহে আয় পুনর্বন্টনের কর্মসূচিগুলো শুধু সরকারই গ্রহণ করতে পারে। কোনো কোনো সরকার এ কাজটি কঠোরভাবে করে থাকে, কেউ কেউ আবার এ ব্যাপারে অতোটা কঠোর নয়।
দুঃখজনকভাবে, একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে আয়-পুনর্বন্টনের কাজে সরকার তেমন একটা সাফল্য দেখাতে পারেনা। যাদের নিকট থেকে সরকারের বড় অংকের কর আদায় করার কথা, সেই ধনীরা রাজনৈতিকভাবে খুবই ক্ষমতাশালী। সরকার যাতে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো কিছু করতে না পারে সেজন্য সরকারকে প্রভাবিত করার মতো বিপুল ক্ষমতা তাদের রয়েছে।
আমি মনে করিনা যে আয়-বৈষম্যের দিকে মনোযোগ দেয়াতে সমস্যার প্রকৃত সমাধান রয়েছে। আমাদের সমস্যার মূলে যেতে হবে, এর বাহ্যিক ফলাফলে নয়। আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে সম্পদের বৈষম্যের দিকে, যেখান থেকে আয়ের বৈষম্য সৃষ্টি হয়। সম্পদের ভিত অপরিবর্তিত থাকলে আয়-বৈষম্য কমিয়ে আনার কোনো প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হবেনা। সর্বোপরি, সরকারের নগদ হস্তান্তর কর্মসূচিগুলো প্রায়ই খয়রাতি কর্মসূচি। এ ধরনের কর্মসূচি সাময়িক উপশমের জন্য চমৎকার হলেও এগুলো সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারেনা। এগুলো বরং সমস্যাকে আড়াল করে রাখে। আইনের শাসনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর পক্ষে সম্পদ পুনর্বন্টনের কাজে হাত দেয়া অত্যন্ত কঠিন। কোনো কোনো গণতান্ত্রিক সরকার দ্বারা ভূমি পুনর্বন্টন কর্মসূচিই সম্পদ পুনর্বন্টনে এ পর্যন্ত একমাত্র সফল কর্মসূচি বলে মনে হয়।
আমি এখন আপনাদের বলতে চাই, একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অর্থনৈতিক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস কেন একান্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
আমি যখন পেছনে ফিরে তাকাই, আমি দেখতে পাই পরিস্থিতি কীভাবে আমাকে এমন সব কাজে ঠেলে দিলো যেগুলো সম্পর্কে আগে আমার কোনো ধারনাই ছিলনা। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ জোবরা গ্রামে সেচ-নির্ভর একটি তৃতীয় শস্য চাষে আমাকে এগিয়ে দিলো। এ কাজ করতে দিয়ে আমি গ্রামের মহাজনী ব্যবসার সাথে পরিচিত হলাম। মহাজনী প্রথার ভূক্তভোগীদের আমি সাহায্য করতে চাইলাম। ১৯৭৬ সালে আমি মহাজনদের কবল থেকে তাদের রক্ষা করতে নিজের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে টাকা দিলাম। ক্রমান্বয়ে আরো বেশী লোককে ঋণ দিতে গিয়ে আমার নিজের পকেটের টাকা শেষ হবার উপক্রম হলো। তখন আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত জনতা ব্যাংকে গেলাম আর তাদের অনুরোধ করলাম গরীব মানুষদের ঋণ দিতে। তারা অস্বীকার করলো। শেষ পর্যন্ত আমি নিজে জামিনদার হয়ে তাদের ঋণ দিতে রাজী করালাম। আমি প্রকল্পটির নাম দিলাম: “গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প।” এরপর কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যক্তিগত আগ্রহে কৃষি ব্যাংক সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। তারা আমাকে কার্যত প্রধান নির্বাহী বানিয়ে জোবরায় কৃষি ব্যাংকের একটি বিশেষ শাখা খুললো, যা ঐ শাখার জন্য আমার নিযুক্ত লোক দিয়ে, যাদের সবাই ছিল আমার ছাত্র, পরিচালিত হতে থাকলো। আমি এর নাম দিলাম “পরীক্ষামূলক গ্রামীণ শাখা।” এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কিছু সদস্যের প্রবল আগ্রহে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকল্পটির কাজ টাংগাইলে সম্প্রসারিত করতে চাইলো। ১৯৮৩ সালে আমরা একটি আনুষ্ঠানিক ব্যাংকে পরিণত হলাম।
তারা যা করে আমরা করি তার উল্টোটা
আমরা যা তৈরী করলাম তা কেবল আরেকটি ব্যাংক ছিলোনা; এটি পরিণত হলো প্রচলিত ব্যাংকের একটি অ্যান্টি-থিসিসে। প্রচলিত ব্যাংক যা করে, গ্রামীণ ব্যাংকে আমরা ঠিক তার বিপরীতটা করতে শুরু করলাম। প্রচলিত ব্যাংকগুলো বড় বড় ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিদের যেখানে কর্মস্থল সেখানে কাজ করতে পছন্দ করে। ফলে তারা শহরে কাজ করে। গ্রামীণ ব্যংক কাজ করে গ্রামে। এমনকি প্রতিষ্ঠার চল্লিশ বছর পরও গ্রামীণ ব্যাংক আজো কোনো শহর বা পৌর এলাকায় তার কোনো শাখা করেনি। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর মালিক ধনী মানুষরা। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক গরীব মহিলারা, এর পরিচালনা পরিষদেও এই গরীব মহিলারা বসেন। প্রচলিত ব্যাংক মূলতঃ পুরুষদের সেবা দেয়, গ্রামীণ ব্যাংক কাজ করে মূলতঃ মহিলাদের নিয়ে। প্রচলিত ব্যাংকগুলো মনে করে যে গরীব মানুষ ঋণ পাবার যোগ্য নয়। ইতিহাসে গ্রামীণ ব্যাংকই সর্বপ্রথম এই ধারনা প্রতিষ্ঠিত করেছে যে গরীব মানুষ, বিশেষ করে গরীব মহিলারা যে-কোনো ব্যাংকিং বিবেচনায় ঋণ পাবার যোগ্য। “গ্রামীণ আমেরিকা” দেখিয়েছে যে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও দরিদ্র মহিলারা ব্যাংক ঋণ দিয়ে তাদের জীবনে চমৎকার পরিবর্তন আনতে পারে। আমেরিকার ৯টি শহরে গ্রামীণ আমেরিকার ১৮টি শাখা রয়েছে যাদের মাধ্যমে ৬০,০০০ মহিলাকে ঋণ সেবা দেয়া হচ্ছে। এঁদের সকলেই মহিলা। “গ্রামীণ আমেরিকা” এ পর্যন্ত ৩৮০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। ঋণ গ্রহীতাদের প্রথম ঋণের পরিমাণ গড়ে ১,০০০ ডলার। ঋণ পরিশোধের হার ৯৯.৯%।
প্রচলিত ব্যাংক কাজ করে জামানতের উপর ভিত্তি করে। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ সম্পূর্ণ জামানত-বিহীন। ফলে এই ঋণ আইনজীবী-বিহীনও। আমরা যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি তা সম্পূর্ণ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। গ্রামীণের ঋণগ্রহীতাদের ব্যাংকের আছে আসতে হয়না, ব্যাংকই তাঁদের দোর গোড়ায় যায়। ঋণগ্রহীতারা যাতে বৃদ্ধ বয়সে নিজেদের দেখাশোনা করতে পারেন সেজন্য গ্রামীণ ব্যাংক তাঁদের জন্য পেনশন ফান্ডের ব্যবস্থা করেছে। গ্রামীণ ব্যাংক তাঁদের জন্য স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থা করেছে, ভিক্ষুকদের ঋণ দিচ্ছে, ঋণী পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা ঋণ প্রদান করছে। এই ব্যাংক তাঁদের স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও নলকুপের জন্যও ঋণের ব্যবস্থা করেছে। কোনো ঋণী মারা গেলে গ্রামীণ ব্যাংক তাঁর দাফনের খরচ আংশিকভাবে বহন করে এবং মৃত ঋণীর সকল ঋণ মওকুফ করা হয়। এই ব্যাংকে ঋণের সুদের পরিমাণ কখনোই মূল ঋণের চেয়ে বেশী হয়না, ঋণ পরিশোধ করতে যত সময়ই লাগুক না কেন।
নভেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক ১.২১ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এবং এ সময়ে ব্যাংকের মোট আদায়যোগ্য ঋণের পরিমাণ ৯,৪০০ কোটি টাকা। একই সময়ে ঋণীদের সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০,৮২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে ঋণীদের মোট আদায়যোগ্য ঋণের চেয়ে ব্যাংকে গচ্ছিত তাঁদের আমানতের পরিমাণ বেশী। কেউ বলতেই পারে, প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা নন, বরং তাঁরাই ব্যাংককে ঋণ দিচ্ছেন!
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্র তহবিল, জাতিসংঘ এবং অনেক দ্বি-পাক্ষিক তহবিল দাতারা অন্তর্ভূক্তিমূলক অর্থায়নকে উৎসাহিত করছে। প্রথাগত ব্যাংকগুলোকে দরিদ্রদের কাছে সীমিত আকারে আর্থিক সেবা পৌঁছাতে এটা উৎসাহিত করে। কেউ যদি সত্যিকারভাবে ব্যাংকিংয়ের মধ্যে অন্তর্ভূক্তিকে আনতে চান, নিশ্চিতভাবেই সেটা প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেমে অর্জন করা সম্ভব নয়। এ-সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেসব নীতি ও কর্ম-পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে কাজ করে তা হলো আর্থিক বহির্ভূক্তি। তাদের ডিএনএ তাদের আর্থিক অন্তর্ভূক্তির পক্ষে কাজ করতে দেবেনা।
আমরা যদি সত্যিই দরিদ্রদের কাছে পৌঁছাতে চাই, তবে আমাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন নকশায় ভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। ধনীদের ব্যাংক গরীবদের সেবার নকশায় তৈরী নয়। তারা বড়জোর, উপর থেকে আসা চাপে, এনজিওদের মাধ্যমে কিছু প্রতীকি কর্মসূচি নিতে পারে, কিন্তু সেটা তাদের ব্যবসায়ের এক শতাংশের কোনো ভগ্নাংশও হবেনা। ব্যাংক-সেবা বহির্ভূত মানুষদের জন্য প্রয়োজন সত্যিকারের ব্যাংকিং, কোনো লোক-দেখানো ভালোমানুষি কর্মসূচি নয়।
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি ব্যাংকিং ব্যবস্থার মৌলিক নীতিগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। আমি যুক্তি দেখিয়ে আসছিলাম যে, আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা মানুষ সম্পর্কে যে তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে অনেক বড়। গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাস তারই জীবন্ত প্রমাণ।
গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণের ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে কারণ এনজিওরা এটিকে গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে পৌঁছাচ্ছে না সেই বিশাল শূন্য যায়গাটা শুধু এনজিওদের দ্বারা পূর্ণ হবার নয়। আমি যুক্তি দেখিয়ে আসছি যে, একটি সহজ পথ হতে পারে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী এনজিওদের ব্যাংকিং লাইসেন্স দেয়া, যাতে তারা ব্যাংক হিসেবে কাজ করতে ও আমানত নিতে পারে এবং এভাবে আত্ম-নির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে। আমি খুবই আনন্দিত যে, বহু বছর চিন্তা-ভাবনার পর ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ভারতের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী এনজিওদের ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকে পরিণত হতে লাইসেন্স দিচ্ছে। এটি হবে অন্তর্ভূক্তিমূলক অর্থায়নের পথে প্রথম সঠিক পদক্ষেপ, যদিও লক্ষ্য অর্জনে আমাদের আরো অনেক এগিয়ে যেতে হবে। ব্যাংক-সেবা বহির্ভূতদের বিভিন্ন অতি প্রয়োজনীয় আর্থিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে একটি শূন্য স্থান এখনো রয়ে গেছে, যেগেুলো হতে হবে বিশেষভাবে তাদেরই জন্য প্রণীত, নিয়মিত গ্রাহকদের জন্য প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার কোনো অতিক্ষুদ্র সংষ্করণ কেবল নয়।
আমি বহুদিন ধরেই যুক্তি দেখিয়ে আসছি যে, ঋণকে একটি মানবিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে যাতে এর প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়া যায় এবং এটিকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেয়া যায়। দরিদ্রদের জন্য একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমেই কেবল আমরা এই মানবিক অধিকারটি প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
গ্রামীণ ব্যাংকের সমালোচকরা বরাবরই বলে আসছিলেন যে, “গরীবদের ঋণ দেয়াটা আসলে অর্থের অপচয়, কেননা তারা জানেনা এ টাকা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। এতে কেবল তাদের ঋণের বোঝাই বাড়ে।” কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। ঋণের বোঝার পরিবর্তে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে তারা বিপুল সঞ্চয়ের মালিক হয়েছে, যা এখন তাদের মোট আদায়যোগ্য ঋণের চেয়ে বেশী। গ্রামীণ ব্যাংক তাদেরকে চমৎকার সঞ্চয়কারীতে পরিণত হতে, মূলধন তহবিলের গর্বিত মালিক হতে এবং আর্থিকভাবে শক্তিশালী ও দেশব্যাপী বিস্তৃত একটি ব্যাংকের মালিক হতে সহায়তা করেছে।
আমি যুক্তি দেখিয়ে আসছি যে, প্রতিটি মানুষই সীমাহীন সৃষ্টিশীল শক্তি নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। সমাজ তাকে তার ক্ষমতা অবারিত করার সুযোগ করে দিলে সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে।
সমালোচকরা উল্টো যুক্তি দেখালেন। তাঁরা বললেন যে, “গরীবের হাতে টাকা দেয়া মানে সেটা অপচয় করা, বরং টাকাটা তারই হাতেই দেয়া উচিত যে অন্য লোককে চাকরি দিতে পারবে।” আমি বিষয়টা সেভাবে দেখলাম না। আমি দরিদ্রতম মহিলাদের মধ্যে চাপা-পড়া উদ্যোক্তার প্রতিভাটি বাইরে বের করে এনে তাদেরকে উদ্যোক্তায় পরিণত করতে চাইলাম। সমালোচকরা এই বিশ্বাস নিয়ে রইলেন যে, উদ্যোক্তা হবার বিষয়টি কেবল কিছু বিশেষ লোকের একটি ছোট্ট শ্রেণীর ব্যাপার, অন্যদের জন্ম হয়েছে তাদের অধীনে কাজ করতে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন যেভাবে চলছে আমরা যদি তাদের সেভাবেই চলতে দিই, তাহলে সেটা সম্পদ-কেন্দ্রীকরণে ঘি ঢালারই সামিল হবে। ব্যক্তিগত সম্পদের কেন্দ্রীকরণ কমাতে হলে আমাদের দু’টো কাজ করতে হবে। বিদ্যমান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে তারা আর সম্পদ-কেন্দ্রীকরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে না পারে। দ্বিতীয়তঃ দরিদ্রদের সকল ধরনের আর্থিক সেবা দেবার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। দরিদ্ররা যাতে তাদের নিজ শক্তিতেই উপরে উঠে আসতে পারে সেজন্য আর্থিক সেবা সরবরাহ করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশেষ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিক ব্যবসা হিসেবে তৈরী করতে হবে যেন তারা ধনীদের ব্যক্তিগত মুনাফা লাভের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে তাদের পক্ষে সম্পদ কেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াকে আরো শক্তিশালী করতে না পারে।
একজন ধনী কীভাবে আরো ধনী হন, তা জানতে হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে ভালভাবে তাকালেই চলবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোই সম্পদ কেন্দ্রীকরণের চালিকা শক্তি। আমরা যদি সম্পদ-পিরামিডকে দরিদ্রদের অনুকূলে রূপান্তরিত করতে চাই, তাহলে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। বিদ্যমান আর্থিক কাঠামো এই সম্পদ-পিরামিডকে কেবল তৈরীই করেনি, একে ক্রমাগতভাবে আরো ভয়াবহ করে চলেছে।
সামাজিক ব্যবসা
দরিদ্রদের সাথে কাজ করতে গিয়ে আমি তাদের আরো অনেক সমস্যার মুখোমুখি হলাম। সেসব সমস্যার কিছু কিছু সমাধানেরও চেষ্টা করলাম। আমি সব সময়ই এক একটি নতুন ব্যবসা সৃষ্টি করে এক একটি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছি। একসময়ে এটা আমার অভ্যাসে পরিণত হলো: যখনই আমি একটা সমস্যার মুখোমুখি হই, তা সমাধানের জন্য আমি একটা ব্যবসা সৃষ্টি করি। শীঘ্রই আমি অনেকগুলো কোম্পানী তৈরী করে ফেললাম, সাথে কোম্পানীর মতো কিছু স্বতন্ত্র প্রকল্পও। যেমন দরিদ্রদের জন্য গৃহায়ণ, দরিদ্রদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, স্বাস্থ্য সেবা, নবায়নযোগ্য শক্তি, পুষ্টি, পানি, নার্সিং কলেজ, চক্ষু হাসপাতাল, অটোমেকানিক ট্রেনিং স্কুল, এবং আরো অনেক।
ক্রমান্বয়ে এগুলো কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিতে শুরু করলো। এগুলো তৈরী হলো টেকসই ব্যবসা হিসেবে, কিন্তু এগুলো থেকে কেউ কোনো ব্যক্তিগত মুনাফা নিতে পারবে না। বিনিয়োগকারী তাঁর বিনিয়োজিত টাকা ফেরত নিতে পারবেন, তবে এর বেশী নয়। কোম্পানীর মুনাফা কোম্পানীতেই পূনর্বিনিয়োগ করা হবে তার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের জন্য। এই নতুন ধরনের ব্যবসাকে আমি নাম দিলাম “সামাজিক ব্যবসা”: মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যক্তিগত লভ্যাংশ-বিহীন ব্যবসা।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ব্যবসা থেকে ব্যক্তিগত লাভের প্রত্যাশা না করে কেবল সমাজের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কোনো ব্যবসা সৃষ্টি করলে তা দিয়ে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কাজটা কত সহজ। আমাদের সবসময় বলা হয়েছে যে, ব্যবসা নামের এই যন্ত্রটির একটিই ব্যবহার আছে, আর তা হচ্ছে টাকা বানানো। আমি এই যন্ত্রটিকেই সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলাম, অর্থাৎ মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কাজে। আর এ কাজে ব্যবসাকে আমি অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকায় দেখতে পেলাম। হঠাৎ করে সমস্ত সৃষ্টিশীল শক্তিকে একটি লক্ষ্যে - মানুষের সমস্যা সমাধানে - এই যন্ত্রটির পেছনে সম্মিলিত করা সম্ভব হয়ে উঠলো।
আমি ভাবলাম, পৃথিবীতে সমস্যা সমাধানের কাজটি কেন শুধু সরকার বা চ্যারিটির উপর ছেড়ে দেয়া হলো? আমি এর জবাব খুঁজে পেলাম। কারণ অর্থনৈতিক তত্ত্বে ব্যবসার দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য টাকা বানানো। মানুষের সমস্যা সমাধানের কাজটি ছেড়ে দেয়া হয়েছে সরকার ও চ্যারিটির উপর। একজন ব্যবসায়ী কেবল আত্ম-স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হবেন, এমনটাই সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তাঁর কাছে ব্যবসা মানে ব্যবসাই। কিন্তু প্রকৃত মানুষতো টাকা বানানোর রোবট নয়। মানুষ একটি বহুমাত্রিক প্রাণী, যার মধ্যে স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা দু’টোই আছে। আমি যখন একটি সামাজিক ব্যবসা তৈরী করি, তখন আমি পরার্থপরতাকে ব্যবসায়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশের সুযোগ করে দিই। পুরাতন ব্যাখ্যা অনুসারে পরার্থপরতা ব্যবসায়িক জগতের অংশ হতে পারেনা, এটি চ্যারিটির জগতের অংশ। আমার যুক্তি হচ্ছে, মানুষের ডিএনএ-তে পরার্থপরতা থেকে থাকলে সেটাকে ব্যবসার জগত থেকে দূরে রাখতে হবে কেন? ব্যবসার জগতে স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতা দু’টোকেই পক্ষপাতহীনভাবে চলতে দেয়া উচিত। অর্থশাস্ত্রের টেক্সট বইগুলোর উচিত ছাত্রদের দু’ধরনের ব্যবসার সাথেই পরিচিত করানো: আত্ম-স্বার্থ চালিত ব্যবসা ও পরার্থপরতা-চালিত ব্যবসা। কে কোনটা বেছে নেবে - তারা কি বিভিন্ন অনুপাতে দু’ ধরনের ব্যবসারই কোন সংমিশ্রণ তৈরী করবে, নাকি তারা প্রত্যেকটিই আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠা করবে - তা তরুণ ছাত্রদের উপরই ছেড়ে দেয়া হোক।
আত্ম-স্বার্থ চালিত ব্যবসায়ে অনেকেই তাঁদের স্বার্থপরতাকে চূড়ান্ত রূপে প্রকাশ করেন, তাঁরা সীমাহীনভাবে লোভী হয়ে ওঠেন। টাকার জন্য নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এই প্রক্রিয়ায় মানবজাতি তার মানবীয় পরিচিতি হারানোর প্রায় একেবারে শেষ প্রান্তে পোঁছে গেছে। মানুষ প্রকৃতপক্ষে ভালবাসা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা ও বন্ধুত্ববোধ সম্পন্ন একটি সত্ত্বা। আমরা যদি এমন একটি তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারি যা আমাদের চরিত্রের গভীরে প্রোথিত মানবিক মূল্যবোধগুলোকে আমাদের অর্থনৈতিক জীবনে প্রকাশিত হবার সুযোগ করে দেবে, তাহলে আমরা সম্পদ-পিরামিডকে সম্পদ-রুহিতনে (Wealth-Diamond) পরিণত করতে পারবো। এই মূল্যবোধগুলো সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে পরিষ্ফুট হয়ে আমাদের সেখানে পৌঁছে দিতে পারে।
সামাজিক ব্যবসাকে দু’টি প্রেক্ষিত থেকে দেখা যেতে পারে। চ্যারিটির দৃষ্টিকোণ থেকে একে টেকসই দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা যায়। ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে একে পরার্থপর ব্যবসা হিসেবে দেখা যেতে পারে। সামাজিক ব্যবসার একটি বড় জিনিষ এই যে, এর পেছনে কাজ করে সদিচ্ছা, কোনো বাধ্যবাধকতা নয়। কেউ তার ইচ্ছা মত সামাজিক ব্যবসা করতে বা তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এতে মানুষ স্বাধীন বোধ করে, কী করতে চায় তা ঠিক করতে পারে।
আমি আনন্দিত যে সামাজিক ব্যবসার ধারণাটি পৃথিবীর সকল দেশে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশ্ববিদ্যলয়গুলো সামাজিক ব্যবসা কেন্দ্র চালু করছে, বহুজাতিক কোম্পানীগুলো সামাজিক ব্যবসা চালু করতে এগিয়ে আসছে, তরুণ প্রজন্ম এই ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আমরা মানুষরা নিজেরাই আমাদের সব সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম - এই ধারণায় বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারুণ্য, প্রযুক্তি ও সামাজিক ব্যবসার সম্মিলিত শক্তি একে সম্ভব করে তুলবে।
প্রযুক্তি
প্রযুক্তি প্রচন্ড গতিতে প্রসারিত হচ্ছে। আজ যা অসম্ভব, তা কালই সম্ভব হচ্ছে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পরিবর্তন প্রতিনিয়ত এত দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে ঘটছে যে তা আমাদের আর অবাক করেনা। অবিশ্বাস্য তথ্য প্রযুক্তির পুরো শক্তিটা ভোগ করছে তরুণ প্রজন্ম। তারা তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের চেয়ে অনেক দ্রুততার সাথে নতুন প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করতে পারে। তাদের কল্পনার শক্তিই কেবল নতুন নতুন প্রযুক্তির সীমানা। তাদের কল্পনা যতো সাহসী, তাদের অর্জনও তত বড়। তারা যদি এমন বিশ্ব কল্পনা করতে শুরু করে যেখানে কোনো সম্পদ বৈষম্য থাকবে না, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে সম্পদ বৈষম্য বলে কিছু থাকবে না। তারুণ্য, প্রযুক্তি ও সামাজিক ব্যবসার মিলিত শক্তি হতে পারে অপ্রতিরোধ্য।
শিক্ষাকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে
সম্পদ কেন্দ্রীকরণের সমস্যা বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হলে শিক্ষাকে মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য পূনঃনির্ধারণ এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর অনেক উচ্চাকাংখী লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল কাজ হয়ে গেছে তরুণদেরকে চাকরীর জন্য তৈরী করা। ধরে নেয়া হয় যে, প্রতিটি তরুণকেই চাকরী খুঁজে নিতে সক্ষম হতে হবে। চাকরী খোঁজার সক্ষমতার কাছে শিক্ষার আর সকল উদ্দেশ্যই গৌণ হয়ে গেছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নিজেকে আবিষ্কার করতে ও জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেতে একজন তরুণকে সাহায্য করা। এ